মহান মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলাধীন তেলিয়াপাড়ার একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। এখান থেকেই যেমন মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ও রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রস্তাব তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রথম পাঠের অনুশীলন হয় তেমনি এখানে সংগঠিত হয়েছে বহু সম্মুখ সমর। ২৮ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত সময়ে এখানে সংগঠিত নানা বিষয় যেমন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইতিহাসের অমূল্য উপাদান; তেমনি সম্মুখ সমরক্ষেত্র হিসেবেও এ স্থানের রয়েছে অতুলনীয় গৌরব-গাঁথা।
২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের অধীন বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যার যার অবস্থান থেকে বিদ্রোহ করে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধাপ্রাপ্ত একটি সুসজ্জিত বিশাল সামরিক বাহিনীকে তৎকালীন সমস্যাসঙ্কুল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও খুবই সীমিত সামর্থ নিয়ে প্রতিহত করা সহজসাধ্য ছিল না। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন ছিল একটি সরকার এবং কেন্দ্রীয় নেতেৃত্বের অধীন সম্মিলিত সামরিক প্রয়াশ। কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনো সরকার গঠিত না হওয়ায় সে সুযোগ ছিল না। এসব দিক বিবেচনায় সর্ব প্রথমে মেজর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহী সেনা ইউনিটগুলোকে একটি একক কমান্ডে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতেই তেলিয়াপাড়া মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
তেলিয়াপাড়াকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী হিসেবে পরিচিত করার মূল ভূমিকা পালন করেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত ৪র্থ বেঙ্গলের মেজর শাফায়াত জামিল কর্তৃক অবাঙ্গালি অধিনায়ক লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত খানসহ ৩জন পাকঅফিসারকে বন্দী এবং সাধারণ অবাঙালি সেনাদের হত্যার পর পরই শমসেরনগর থেকে ফিরে এসে সহ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ ইউনিটের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টেলিফোনে বিভিন্ন স্থানে তাঁর বিদ্রোহের সংবাদ প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেখানকার তৎকালীন এসডিও কাজী রকিব উদ্দিন আহমদেসহ স্থানীয় ইপিআর ও মহকুমা পুলিশ অফিসার সর্বাত্বক সহযোগিতা করেন।১
অতঃপর সম্ভাব্য বিমান হামলা এড়াতে তিনি ঐদিন মধ্য রাতেই (২৮ এপ্রিল) ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তর প্রথমে মাধবপুর ডাকবাংলায় এবং পরদিন ২৯ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থানান্তর করেন।২ সেখান থেকে পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় তেলিয়াপাড়া বিওপি-এর কাছে ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়। উভয় পক্ষের আলোচনায় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়।৩ তিনি ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সহযোগিতায় বাংলাদেশেরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সেনা কর্মকর্তা ও ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে প্রথমে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে ৪র্থ বেঙ্গলের সাথে যৌথভাবে সদর দপ্তর স্থাপন করেন।৪ ইতোমধ্যে তেলিয়াপাড়ায় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সমবেত হন। ১ এপ্রিল বিকেলে ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন।৫ ২ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া সীমান্তের ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ডে’বিএসএফ-এর আইজি এবং আগরতলার ডিসি মি. সায়গল এসে মেজর খালেদ এবং শাফায়াতের সাথে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন।৬ ৪ এপ্রিল সকালের মধ্যেই সেনা কর্মকর্তাদের সকলে তেলিয়াপাড়া বাংলোতে উপস্থিত হন। ১০টার দিকে ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে সঙ্গে নিয়ে তেলিয়াপাড়াস্থ সেনা সদরে এসে উপস্থিত হন।৭ সকাল ১১টায় সভার কার্যক্রম শুরু হয়।
ঐতিহাসিক এ সভায় কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী এমএনএ, লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ রব এমএনএ, লেঃ কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল উপস্থিত ছিলেন।
সভার কার্যক্রম শুরু হলে এর লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ।৮ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তসমূহ ছিল নিম্নরূপ :৯
এক. কনফারেন্সে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাগণ সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিগেডিয়ার পান্ডের কাছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবরাহের আবেদন জানান। এ ব্যাপারে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত আকারে হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের আশ্বাস দেন।
দুই. মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখ- ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব সায়গাল ভারতীয় ভূখন্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শরনার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
তিন. সভায় বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল ওসমানীকে সমম্বয় সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয়।
চার. ব্রিগেডিয়ার পান্ডে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধরত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কোথায় কী ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে তা নিয়মিত মনিটরিং করার দায়িত্ব নেন। তিনি সীমান্তবর্তী বিএসএফ-এর কর্মকর্তাদের বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্যের নির্দেশ দিবেন বলেও আশ্বাস দেন।
পাঁচ. উপস্থিত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাগণ এদিনের কনফারেন্সে দেশটিকে ৪টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১ জন করে সেনা কর্মকর্তা নির্বাচিত করেন।
ছয়. বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। বৃহত্তর সিলেট এবং ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর সফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে।
সাত. চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে ঐদিনই ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে ২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি রামগড়ের উদ্দেশ্যে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ঐ রাতেই বিএসএফ-এর গাড়ি দিয়ে এ দু’টি কোম্পানিকে ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন।
আট. উক্ত সভায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সেনা সদস্যদের বিদ্রোহকে আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্ত অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
নয়. সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল এম এ জি ওসমানী একজন নির্বাচিত এমএনএ বিধায় তাঁকে শীঘ্রই সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্যান্য গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তামজী, ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানান।
দশ. কনফারেন্সে আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে আরেকটি কনফারেন্স অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে। তাই নিকট অতীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদাহরণ বিশ্লেষণ করে সভার লিখিতাকারে কোনো সিদ্ধান্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। ‘মৌখিকভাবে বাহিনীর সংগঠন, নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার যে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায়। ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণে এই সভার সিদ্ধান্তের কিছু অংশ উচ্চারিত হয়েছিল। পরে এই সভার সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে আরও সময়োপযোগী করে তোলা হয়’।১০ ‘এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে’।১১
সভা শেষে কর্নেল ওসমানী তাঁর রিভলভার থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।’১২
তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক :
৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তানুযায়ী ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় ২য় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১ম সভায় উপস্থিত প্রায় সকলেই উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সভাটি ১ম সভার সিদ্ধান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। উক্ত সভার সিদ্ধান্ত ছিল : ১৩
সভার প্রথমেই কর্নেল এম এ জি ওসমানীর কাছে গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে তিনি কতদূর অগ্রসর হয়েছেন, তা জানাতে অনুরোধ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকারী বেশ কিছু সংখ্যক এমএনএ এবং এমপিএ-এর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অধিকাংশ গণপ্রতিনিধিই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ শীঘ্রই একটি ‘বাংলাদেশ সরকার’গঠনের ঘোষণা দিবেন বলে তাঁকে আশ্বস্থ করেছেন।
বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধটিকে সমম্বিত এ্যাকশনে রূপ দেয়া এবং কমান্ড চ্যানেলে আনার লক্ষ্যে এদিন পুরো দেশটিকে ৪টির স্থলে ৬টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন দু’টি সামরিক অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেবার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। ৬টি অঞ্চলের কমান্ডারদেরকে তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদেরকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত এ্যাকশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিগণ জানান যে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার লক্ষ্যে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এদের জন্য ইতোমধ্যেই অস্থায়ীভাবে বেশ কিছু ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। শরনার্থীদের জন্যও ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএসএফ-এর সৈন্যরা বিদ্রোহী বাহিনীর সহযোগিতায় অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর পরই ভারতীয় পক্ষ থেকে সাহায্যের পরিমাণ বাড়বে বলে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে সকলকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির ব্যাপারটিও ঐ দিনের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ব্যাপারে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে জানানো হয়।
তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত ক্রান্তিকালের সেই সভাদু’টি কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রথম সমম্বয় সভাই নয় বরং মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচনা প্রথম মাইলফলক হিসেবেও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রবন্ধ : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার-এর 'মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী তেলিয়াপাড়া' থেকে সংকলিত।
তথ্যসূত্র :
১. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), সাহিত্য প্রকাশ তৃতীয় মুদ্রণ ২০০৯। পৃষ্ঠা ৩০।
২. মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড ২০১৭। পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬।
৩. প্রসঙ্গ : মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান; উৎস প্রকাশন ২০১১। পৃষ্ঠা ৬৩।
৪. মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম সফিউল্লাহ’র সাক্ষাৎকার। সূত্র: প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান; উৎস প্রকাশন ২০১১। পৃষ্ঠা ২৮৪।
৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ২৯।
৬. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), সাহিত্য প্রকাশ তৃতীয় মুদ্রণ ২০০৯। পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪।
৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ৩০।
৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ৩০-৩১।
১০. ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে, এ কে খন্দকার। প্রথমা প্রকাশন দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৪। পৃষ্ঠা ৯০।
১১. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ্ বীর উত্তম। আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৯১।
১২. তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের ২০১১ সালের মহা সম্মেলনে মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম সফিউল্লাহ’র স্মৃতিচারণ মূলক বক্তৃতা।
১৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ৩২-৩৩।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোর পূর্ব dlcj নির্মাণ করা হয়েছে ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই সৌধের সামনে দু’টি ফলকে অঙ্কিত রয়েছে শামসুর রাহমান’এর বিখ্যাত “স্বাধীনতা তুমি” কবিতা। চারপাশের চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধসহ রয়েছে একটি লেক। লাল শাপলা ফোটা এই লেক বর্ষাকালে আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক তাৎপর্য
১৯৭১ সাল এ দেশের মানুষের কাছে যেমন গৌরবের তেমনি বিভীষিকাময়ও। গৌরবের এ জন্যে যে, রাষ্ট্রীয় নগ্ন নির্দেশপুষ্ট সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল একটি হিংস্র বাহিনীর বিপরীতে কেবলমাত্র আত্মবিশ্বাসসমৃদ্ধ একদল নিরস্ত্র মানুষ মাত্র ৯মাসে ছিনিয়ে এনেছিল একটি নতুন পতাকাÑ নতুন মানচিত্র। যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিভীষিকাময় এ জন্যে যে, বর্বর পাকসেনারা সেদিন বাংলার বুকে এঁকে দিয়েছিল পৈশাচিকতার এক ভয়ঙ্কর চিত্র। ওদের নখরাঘাতে ক্ষরিত শোণিত ধারায় সেদিন শ্যামল-সুন্দর এ দেশে প্রবাহিত হয় রক্তগঙ্গা। ক্ষত-বিক্ষত হয় প্রতিটি থানা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। আজও সে ভয়াল স্মৃতি প্রতিটি মানুষের মনে জাগরুক।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ওদের পশুত্বের ছোবল দেশের সর্বত্র সমান ছিল না। সে বিবেচনায় মাধবপুরের একটি পৃথক অবস্থান বিদ্যমান। মূলত এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এখানকার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোটি সেই ইতিহাসের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ সূচনাকালে প্রায় প্রতিটি মূল ক্রিয়া এখান থেকে সম্পাদিত হয়েছে। সেইসব গৌরবগাঁথার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য :
১. মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৭ মার্চ দিবাগত রাতে মাধবপুর এসে এখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানের প্রতিরক্ষা-প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে ২৯ মার্চ তাঁর সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্থানান্তর করেন। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের এলাকা সিলেট পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়।১
২. মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া থেকেই সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর পাশাপাশি ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়া হয়।
৩. মেজর খালেদ মোশাররফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বপ্রথম ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ কিশোরগঞ্জ থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন।২
৪. ১ এপ্রিল থেকে তেলিয়াপাড়ায় ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের যৌথ সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।৩
৫. ১ এপ্রিল বিকেলে ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে তেলিয়াপাড়া বাগানে এসে লে. কর্নেল এস এম রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়ার রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন।৪
৬. ২ এপ্রিল আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল তেলিয়াপাড়া বিওপি-র কাছে এসে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের পদক্ষেপ নেন।৫ ৩ এপ্রিল মেজর জিয়াউর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলোতে আসেন।৬ ৪ এপ্রিল সকালের মধ্যে লেঃ কর্নেল আব্দুর রব, লেঃ কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীসহ বহু সেনা কর্মকর্তা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন সেখানে আসেন।৭
৭. ঐ দিন সকাল ১০ টার দিকে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে সঙ্গে নিয়ে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হন।৮
৮. ৪ এপ্রিলের ঐতিহাসিক সেনা সভায় কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী এমএনএ, লেঃ কর্নেল আব্দুর রব এমএনএ, লেঃ কর্নেল এস এম রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল উপস্থিত ছিলেন।৯
৯. তেলিয়াপাড়াকে প্রথম অস্থায়ী সেনা সদর গণ্য করে মুক্তিযুদ্ধ কালে মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী সর্বমোট ৩টি সভার মধ্যে প্রথম দুটি সভাই এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
১০. পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনারা যার যার অবস্থান থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম সেনা সভার মাধ্যমেই বিদ্রোহী সকল সেনা ইউনিটগুলো বজ্রকঠিন শপথের মাধ্যমে একক কমান্ডের অধীনে চলে আসে।
১১. ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এ সেনা সভা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা এবং মুক্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।১০
১২. তখন পর্যন্ত কেনো সরকার গঠিত না হওয়ায় ঐ সেনা সভায় কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও লেঃ কর্নেল এম এ রবকে একাধারে গণপ্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বিবেচনায় যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও উপ সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কর্নেল ওসমানী ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং এরপর হতে মন্ত্রীর মর্যাদায়১১ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৩. এ সভায়ই ভারতীয় প্রতিনিধি দল তাদের সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ ও মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে।১২
১৪. এখানেই রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রথম প্রস্তাব হয়।১৩
১৫. কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তৎপরতায় জননেতা তাজউদ্দীন আহমেদ অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ ১১ এপ্রিল আগরতলা এসে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করেন। স্থানটি ঢাকা-সিলেট সড়ক ও রেলপথের খুবই নিকটবর্তী এবং এখানে বিমান হামলার সম্ভাবনা থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকির চিন্তা করে প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়।
১৬. ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায়ই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও মূল কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।
১৭. তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত ৪ এপ্রিলের সভায় ৪ টি১৪ ও ১০ এপ্রিলের সভায় সমগ্র দেশকে ৬ টি১৫ সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য একজন অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায়ই সাধারণ ছাত্র-জনতাকে স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণের মাধমে মুক্তিবাহিনীতে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। যার ফলশ্রুতিতে মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ইতঃপূর্বে সংগঠিত ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে তেলিয়াপাড়াস্থ বাঁশবাড়ি ক্যাম্পে সর্বপ্রথম গেরিলা প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। প্রথম ব্যাচে এখানে ২০০০ যুবক দুসপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।১৬
১৮. মাধবপুর ও চুনারুঘাট এলাকায় ৩ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক হানাদার বাহিনীর অন্তত ২০টি গেরিলা ও সম্মুখ সমর সংঘটিত হয়।
১৯. ১৯ মে পর্যন্ত তেলিয়াপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। কেবলমাত্র তেলিয়াপাড়া দখলে রাখতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়। এতে মোট ৮৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন; পক্ষান্তরে প্রায় ২১০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
২০. সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে ৩ এপ্রিল মেজর জিয়াউর রহমান রামগড় থেকে তেলিয়াপাড়া বাগানের ডাকবাংলোতে আসেন। সভার পর এখান থেকে ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের ব্র্যাভো কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন ইজাজ আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গলের ব্র্যাভো কোম্পানি মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ১নং সেক্টরে যোগদান করে।১৭
এ ছাড়া আরো অনেক ঘটনার জন্য তেলিয়াপাড়া চা বাগান মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রবন্ধ : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার। লেখকের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী তেলিয়াপাড়া গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
তথ্যসূত্র :
১. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমান, আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৭৯।
২. দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-৩। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ২৯।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-৩। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ২৯। কোনো কোনো সূত্রে ২য় বেঙ্গলের সদর দপ্তর স্থানান্তরের তারিখ ৩ এপ্রিল বলা হয়েছে।
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-৩। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ২৯।
৫. মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ময়মনসিংহ; সম্পাদনা : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.কে. মোহাম্মদ আলী ও অন্যান্য; এরিয়া সদর দপ্তর, ময়মনসিংহ ২০০১। পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।
৬. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমান, আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৭৯।
৭. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমান, আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৯০।
৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-৩। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা ২৯।
৯. ক. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-৩, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৬। পৃষ্ঠা বার। উক্ত গ্রন্থে আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গলকে ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব সায়গল বলা হয়েছে। খ. প্রসঙ্গ : মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান, উৎস প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৬৯। গ. মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল্স্ ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস। মাওলা ব্রাদার্স ১৯৯৯। পৃষ্ঠা ২২৬। ঘ. মূলধারা ৭১, মঈদুল হাসান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ১৫। ঙ. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ হাননান। এ হাকিম এন্ড সন্স, কলকাতা ১৯৯৪। পৃষ্ঠা ৩৮৩। (মূলধারা ৭১ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে কাজী রকিব উদ্দিন ও ভারতীয় প্রতিনিধির উল্লেখ নেই, অতিরিক্ত হিসেবে মেজর মমিন চৌধুরীর উল্লেখ আছে।) চ. জনতার যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ, মুহাম্মদ লুৎফুল হক। প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর ২০১০।
১০. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমান, আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৯১।
১১. বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ.টি.ইমাম; আগামী প্রকাশনী ২০০৪। পৃষ্ঠা ১১৯।
১২. এপ্রিলের ৪ তারিখে অনুষ্ঠিত সভার ১নং ও ৪নং সিদ্ধান্ত দ্রষ্টব্য। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড ২০১৭। পৃষ্ঠা ৬৩।
১৩. ক. ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার ৯নং সিদ্ধান্ত দ্রষ্টব্য। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড ২০১৭। পৃষ্ঠা ৬৫। খ. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী মাহবুব উদ্দিন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য। গ. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৯১।
১৪. মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড ২০১৭। পৃষ্ঠা ৬৪।
১৫. মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড ২০১৭। পৃষ্ঠা ৭১।
১৬. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমান, আগামী প্রকাশনী ২০০১। পৃষ্ঠা ৮৭।
১৭. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। অনুবাদ : সিদ্দিকুর রহমা
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS